জিন তাড়ানোর দোয়া ও নিরাপদ থাকার আমল

জিনে প্রভাবিত ব্যক্তির স্বাভাবিক আচার-আচরণ বদলে যেতে পারে। শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। আলো সহ্য করতে পারে না। আজানের সময় অস্থির হয়ে পড়তে পারে। রাতে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারে। এ রকম সময় আল্লাহর আশ্রয় চাইতে হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো প্ররোচনা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে তুমি আল্লাহর আশ্রয় চাও। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আল-আরাফ, আয়াত : ২০০)। সুরা নাছ ও সুরা ফালাক সর্বোপরি কার্যকর।

জিন তাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর দোয়া হলো আয়তুল কুরসি। জিনে আছরের ঘটনা হাদিসে পাওয়া যায়। হাদিসে আছে, ‘রাসুল (সা.) একবার একটি অসুস্থ বালকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, যার ওপর জিনের ভর ছিল। রাসুল (সা.) ছেলেটির দিকে ফিরে জোরে বলেন, ওহ আল্লাহর শত্রু, বের হয়ে আসো। ওহ আল্লাহর শত্রু বের হয়ে আসো। তখন ছেলেটি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৫৪৮, আহমদ, হাদিস : ৪/১৭১,১৭২)

অনেক দুষ্ট জিন আছে, যারা সুযোগ পেলেই মানুষের ক্ষতি করে বসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা বাচ্চা ও নারীদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন—ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ কেঁদে ওঠা, উচ্চ স্বরে কথা বলা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলা এবং ঘুম থেকে আতঙ্কিত অবস্থায় বসে পড়া বা দাঁড়িয়ে যাওয়া।

এছাড়া জাগ্রত অবস্থায় এমন কিছু দেখা, যা স্বপ্ন মনে হবে। হঠাৎ হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে যাওয়া। সব সময় ভীতু ভাব থাকা। কখনও ভিন্ন ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলা। আশ্চর্যজনক আচরণ প্রকাশ পাওয়া, যেমন অল্প সময়ে বহুদূর চলে যাওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্বামী-সন্তান ও সংসার বিরক্তিকর হয়ে ওঠা। কোরআন তেলাওয়াত ও জিকির শুনলে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া। যেহেতু খারাপ জিনরা এসব সহ্য করতে পারে না। আক্রমণাত্মক ও ভয়ংকর স্বপ্ন দেখা। যেমন—কালো কুকুর, কালো সাপ, কালো বিড়াল অথবা পাহাড় বা উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া অথবা পানিতে পড়ে যাওয়া।

কানে শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনাও এমন লক্ষণ। এছাড়া শরীরের ভারসাম্যহীনতা অনুভব করা। অল্পতেই রেগে যাওয়া। সর্বদা ঘুমের ভাব লেগে থাকা এবং গভীর ঘুম থেকে জেগে কষ্ট অনুভব হওয়া। কাজকর্মে অনীহা ও বিরক্তি প্রকাশ করা। একাকী ও নির্জনতা পছন্দ করা। হঠাৎ হঠাৎ আশ্চর্য ধরনের দুর্গন্ধ পাওয়া। এমন কাজ করেছে মনে হওয়া, যা সে করেনি। কাজেকর্মে বেশি ভুল হওয়া। দীর্ঘ সময় টয়লেটে অবস্থান করা, কারো সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদিসহ আরও অনেক অদ্ভুত আচরণ দেখা দিতে পারে।

জিনের আছর থেকে নিরাপদ থাকার আমল

১. সবসময় পবিত্র থাকা। কোনো কারণে গোসল ফরজ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোসল করা।

২. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ও শরিয়ত মোতাবেক চলা।

৩. ঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সুন্নাহ বর্ণিত দোয়া পড়া। ঘরে প্রবেশের সময় সালাম করে প্রবেশ করা।

৪. প্রস্রাব-পায়খানায় যাওয়ার সময় দোয়া পড়া। সেখান থেকে ফিরেও দোয়া পড়া। কারণ এসব জায়গায় দুষ্ট জিনদের আনাগোনা বেশি থাকে।

৫. ঘরে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করা। বিশেষ করে সুরা বাকারা তেলাওয়াত করা।

৬. প্রতি নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করা। ঘুমানোর সময় আয়াতুল কুরসি পাঠ করে ঘুমানো।

৭. খাবারের সময় মাসনুন দোয়া পড়া। কারণ দোয়া না পড়লে দুষ্ট জিনের আমাদের খাবারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে। গোশত খাওয়ার পর হাড়গুলো পানিতে না ফেলা, কারণ এগুলো জিনদের খাবার। এগুলো নষ্ট করলে তারা কষ্ট পায়। অনেক ক্ষেত্রে এ কারণেও আক্রমণ করে বসতে পারে।

৮. ঘরে কোনো প্রাণীর কঙ্কাল ও মূর্তিজাতীয় জিনিস না রাখা।

৯. নির্জন বা ময়লার স্তূপ, আগুনের কুণ্ডলীর কাছে একাকী না যাওয়া।

১০. জনমানবহীন স্থান, গভীর জঙ্গলে রাতের বেলায় একা সফর না করা।

১১. কোনো অবস্থায় ভয় পাওয়া যাবে না। কারণ ভয় পেলে তারা আরো বেশি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।

১২. ভরদুপুর ও সন্ধ্যায় বাচ্চাদের ঘরের বাইরে না রাখা।

১৩. সকাল-সন্ধ্যা এবং শোবার সময় সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস তিনবার করে পড়ে হাতের মধ্যে ফুঁক দিয়ে শরীরে মুছে নেওয়া।

১৪. সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বিসমিল্লাহ বলে ঘরের দরজা ও জানালা বন্ধ রাখা। এবং নারী ও শিশুদের জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে না দেওয়া। রাতের এক প্রহর যাওয়ার পর এ বাধ্যবাধতা নেই।

জিনে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা

উলামায়ে কেরাম অভিজ্ঞতার আলোকে জিনে আক্রান্ত রোগীর সামনে এমন কিছু আয়াত পড়েন, যেগুলো তেলাওয়াত করলে জিনরা দিশাহারা হয়ে যায়। যেমন—কাউকে জিন আছর করেছে মনে হলে প্রাথমিকভাবে তার কানের কাছে উচ্চ স্বরে নিম্নের আয়াতগুলো পাঠ করতে হবে। এতে তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে আয়াতগুলো আরো বেশি বেশি পাঠ করতে হবে। এতে জিন অনেক ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কোরআন পাঠ করানোর চেষ্টা করবে। রোগীর মুখ দিয়ে অনেক কথা বলাবে। কিন্তু থামা যাবে না। যদি কোনো কারণে থামতেই হয়, তাহলে সুরা ফালাক, নাস ও দরুদ শরিফ পড়ে থামতে হবে।

যে আয়াতগুলো পড়তে হয়-

* সুরা ফাতেহার সব আয়াত।

* সুরা বাকারার ১-৫, ১৬৪, ২৫৫-২৫৭, ২৮৫-২৮৬।

* সুরা আলে ইমরানের ১৮-১৯ নম্বর আয়াত।

* সুরা আরাফের ৫৪-৫৬ নম্বর আয়াত।

* সুরা মুমিনুনের ১১৫-১১৮ নম্বর আয়াত।

* সুরা সফফাতের ১-১০ নম্বর আয়াত।

* সুরা আহকাফের ২৯-৩২ নম্বর আয়াত।

* সুরা আর রাহমানের ৩৩-৩৬ নম্বর আয়াত।

* সুরা হাশরের ১২-২৪ নম্বর আয়াত।

* সুরা জিনের ১-৯ নম্বর আয়াত।

* সুরা হুমাজাহর ১-৭ নম্বর আয়াত।

* সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস।

তবে এই আয়াতগুলো পড়ার পর জিন রোগীর শরীরে ঝাঁকুনি দিতে পারে। তাই কোনো ভীতু লোক এ ধরনের চিকিৎসার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। সে ক্ষেত্রে উল্লিখিত সুরাগুলোর অডিও ক্লিপ রোগীকে শোনানো যেতে পারে। অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য নিজেও বেশি বেশি এই সুরাগুলো শুনতে পারে।

কিছু আয়াত এমন আছে, যেগুলোকে আয়াতুল হরক্ব বলে। এগুলো তেলাওয়াত করলে জিনের খুব কষ্ট হয়। ফলে সে চলে যেতে বাধ্য হয়। আয়াতগুলো হলো- সুরা ফাতেহা। আয়াতুল কুরসি। সুরা নিসা : ১৬৭-১৭৩, সুরা মায়িদা : ৩৩-৩৪, সুরা আনআম : ৯৩, সুরা আরাফ : ৪৪-৫১, সুরা আনফাল : ১২-১৩, সুরা তাওবা : ৭, সুরা ইবরাহিম : ১-১৭, সুরা হিজর : ১৭-১৮, সুরা ইসরা : ১১০-১১১, সুরা আম্বিয়া : ৭০, সুরা দুখান : ৪৩-৫২, সুরা আহকাফ : ২৯-৩৪, সুরা হজ : ১৯-২২, সুরা মারিয়াম : ৬৮-৭২, সুরা মুলুক : ৫-১১ নম্বর আয়াত।

যে কাঠের ঘ্রাণ জিনেরা সহ্য করতে পারে না

একটি বিশেষ কস্তুরি আছে, যার ঘ্রাণ জিনেরা সহ্য করতে পারে না। হাদিসের ভাষায় একে বলা হয়, ‘উদুল হিন্দ’। ভারতীয় কস্টাসে (সুগন্ধিযুক্ত বৃক্ষের) তৈরি নাকের ড্রপ, যা ভারতীয় চন্দন কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। এর ব্যবহারপদ্ধতি হলো—রোগী এ কস্তুরি দ্বারা তৈরিকৃত ড্রপ এমনভাবে নাকে ব্যবহার করবে, যেন তার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ সরাসরি মস্তিষ্কে চলে যায়, যেখানে জিন অবস্থান করে। এতে করে জিন দিশাহারা হয়ে পালিয়ে যায়।

উম্মে কায়েস বিনতে মিহসান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা ভারতীয় এই চন্দন কাঠ ব্যবহার করবে। কেননা তাতে সাতটি আরোগ্য রয়েছে। শ্বাসনালির ব্যথার জন্য এর (ধোঁয়া) নাক দিয়ে টেনে নেওয়া যায়, পাঁজরের ব্যথা বা পক্ষাঘাতের রোগ দূর করার জন্যও তা ব্যবহার করা যায়। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৯২)

তাই চাইলে ঘরে সুগন্ধি চন্দন কাঠ জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া নেয়া যেতে পারে।

Leave a Comment