বাসর রাতের আমল | বাসর রাতে নবদম্পতির করনীয়
মহান আল্লাহ মানব জীবনকে বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেন। এটা নির্মল জীবন যাপনের প্রথম স্তর । আত্মিক প্রশান্তি লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম । নবদম্পতির প্রথম রাতটি বাসর রাত হিসাবে সুপরিচিত ।
নারী পুরুষ সবার জীবনে এ রাত খুব গুরুত্বপূর্ণ । প্রথম রাত থেকে স্বামী স্ত্রী উভয়েই শরিয়ত সম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করলে গড়ে ওঠে পবিত্র ভালোবাসার স্থায়ী মজবুত বন্ধন । বাসর রাতের আমল নিচে তুলে ধরা হলো।
সূচিপত্র
বাসর রাতের আমল – বাসর রাতে কি কথা বলতে হয়
দাম্পত্য জীবন আল্লাহর দেওয়া সেরা একটি নেয়ামত। স্বামী স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ।” ( সুরা বাকারা: ১৮৭)
বাসর রাতে স্বামীর মুস্তাহাব আমল হলো স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা। পরিপাটি নতুন মানুষটির সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন করা। ছেড়ে আসা আত্মীয়-স্বজনের অভাব বুঝতে না দেওয়া।
আরও পড়ুন- স্বপ্নে সুরা ইখলাস পড়লে কি হয়?
প্রিয়তমাকে কিছু উপহার দেওয়া। অন্ততঃ দুধ, মিষ্টি ও শরবত ইত্যাদি একত্রে খাওয়া। এ সম্পর্কে হাদিস এসেছে। বাসর রাতের আমলগুলোর মধ্যে এটির অনেক ফজিলত। হজরত আসমা বিনতে উমাইস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
“আমি ছিলাম আয়েশা (রা.) এর বান্ধবী । আমি আরো কিছু মহিলাকে সাথে নিয়ে তাকে রাসুল (সা.)এর জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছি ও তার ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি ।” আসমা বলেন, আল্লাহ শপথ আমরা তার ঘরে মেহমানদারী হিসেবে এক পেয়ালা দুধ ছাড়া আর কিছু পায়নি ।
তিনি সে পেয়ালা থেকে কিছুটা পান করলেন । এরপর আয়েশা (রা.) কে দিলেন । অল্প বয়সী মেয়েটি লজ্জাবোধ করল । তখন আমরা বললাম ,আল্লাহর রাসুল (সা.)এর হাতে ফিরিয়ে দিও না । গ্রহণ করো । তখন সে ইতস্তত করে হাতে নিল এবং সেটা থেকে পান করল ।
অতঃপর রাসুল (সা.)বললেন,তোমার বান্ধবীদেরকে দাও । আমরা বললাম, আমাদের চাহিদা নেই । তিনি বললেন তোমরা ক্ষুধা ও মিথ্যা দুটোকে একত্র করো না ।” (মুসনাদে আহমাদ ২৬৯২৫ ) ইমাম আহমদ ( রহ.) এর সূত্রে আদাবুয যিফাফ গ্রন্থেও হাদিসটি বর্ধিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে ।
বাসর রাতে কি কথা বলতে হয় – আল্লাহর নাম নেওয়া এবং নববধূর মাথায় হাত রেখে দোয়া করা
বাসর রাতে বা তার পূর্বে স্বামী স্ত্রীর মাথার সম্মুখভাগে হাত রাখা। আল্লাহর নাম নেওয়া । এটি বাসর রাতের আমলগুলোর মধ্যে একটি। অতঃপর হাদিসে বর্ণিত বরকতের দোয়া করা ।
হজরত আমর বিন শুয়াইব (রহ.) তার পিতা থেকে দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন,নবী কারিম (সা.) বলেন,তোমাদের কেউ যখন কোন নারীকে বিবাহ করবে অথবা চাকর ক্রয় করবে, সে যেন তার কপালে হাত রেখে বিসমিল্লাহ পড়ে অতঃপর বলে ,
“আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খইরহা, ওয়া খইরমা জাবালতাহা আলাইহি, ওয়া আউযুবিকা মিন শাররিহা, ওয়া শাররি মা জাবালতাহা আলাইহি।” (আবু দাউদ: ২১৬০)
বাসর রাতে নফল নামাজ পড়ার নিয়ম – নবদম্পতির একত্রে নামাজ
নবদম্পতির বাসর রাতের আমলগুলোর মধ্যে একটি হল একত্রে নামাজ আদায় করা। এটা মুস্তাহাব । সালাফ থেকে এ আমল প্রমাণিত । এ সম্পর্কে দুটো হাদিসের মধ্যে একটি এরকম– হজরত শাকীক (রহ.)থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন :
“জনৈক ব্যক্তি আগমন করল, তাকে আবু হারীয বলে ডাকা হত । তারপর তিনি বলেন, নিশ্চয় আমি একজন যুবতী কুমারী মহিলাকে বিবাহ করেছি। আর আমি ভয় করছি যে, সে আমাকে অসন্তুষ্টি করবে। তারপর আবদুল্লাহ অর্থাৎ ইবনে মাসউদ বললেন, নিশ্চয় বন্ধুত্ব ভালবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর রাগ অসন্তুষ্টি শয়তানের পক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন- স্বপ্নে আয়াতুল কুরসি পড়লে কি হয় ?
শয়তান ইচ্ছা করছে যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বৈধ করেছেন তা সে তোমাদের নিকট ঘৃণা সৃষ্টি করবে। সুতরাং সে যখন তোমার কাছে আসবে তখন তাকে জামাত সহকারে তোমার পিছনে দু’রাকাত নামাজ পড়তে নির্দেশ দিবে। তারপর দোয়া করবে । ইবনু মাসউদ (রাঃ)-এর অন্য বর্ণনায় একটু বৃদ্ধি আছে ।
তিনি বলেছেন তুমি বল, হে আল্লাহ! আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দান করুন এবং তাদের স্বার্থে আমার মাঝে বরকত দিন। হে আল্লাহ! আপনি যা ভাল একত্রিত করেছেন তা আমাদের মাঝে একত্রিত করুন।
আর যখন কল্যাণের দিকে বিচ্ছেদ করবেন তখন আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ করুন।” (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা:১৭১৫৬, মুজামুল কাবির : ৮৯০০, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৭৫৪৭, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক:১০৪৬১ )
নতুন বিবাহের দোয়া – বাসর রাতের দোয়া ও নামাজ
জৈবিক চাহিদা প্রত্যেকটি মাখলুকের মধ্যে আছে । সবাই সবার নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেটা পূরণ করে থাকে । মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ায় তাদের জৈবিক চাহিদার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র হওয়ারই দাবিদার ।
হাদিসে এসেছে সহবাসের আগে রাসুল (সা.)এই দোয়াটি পাঠ করতে বলেছেন , বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শাইতনা ওয়া জান্নিবনাশ শাইতনা মা রজাকতানা। ( বোখারী: ১৪১,৩২৭১)
দোয়াটি পাঠ করার বড় পুরস্কার হলো যদি এ সহবাস দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ওই নবদম্পতিকে কোন সন্তান দান করেন তাহলে শয়তান সন্তানের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না । ( আবু দাউদ:২১৫৮ ) এটি বাসর রাতের আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাসর রাতের নিয়ম কানুন – সহবাসের সময় স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধামত পদ্ধতি নির্বাচন করা
বাসর রাতের আমলগুলোর মধ্যে এটি একটি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে , মুহাম্মদ ইবনে আল মুনকাদির (রহ.) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন আমি জাবের (রা.)কে বলতে শুনেছি যে, ইহুদিরা বলতো যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে পশ্চাত দিক থেকে তার যৌনাঙ্গে সহবাস করে তখন যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে সে টেরা হয় ।
তখন আল্লাহ তায়ালা এ আয়াত নাজিল করেন, তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য ক্ষেত স্বরূপ। কাজেই তোমরা তোমাদের ক্ষেত্রে যে রূপে ইচ্ছে সে রূপে গিয়ে ফসল উৎপাদন কর । (সুরা বাকারা:২২৩) ( আবু দাউদ: ২১৬০)
আরও পড়ুন- গায়েবী ধন পাওয়ার দোয়া – গায়েবী টাকা পাওয়ার উপায়
এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইহুদীদের ভ্রান্ত মতবাদের অসারতা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস করা হারাম। এ অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন,
“মহান আল্লাহ (কেয়ামতের দিন )ওই ব্যক্তির দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) দেখবেন না ,যে তার স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস করে । ( ইবনে মাজাহ: ৬৩৯) হাদিসে আরো কঠোর বার্তা এসেছে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর পশ্চদদ্বারে সহবাস করে সে অভিশপ্ত ।” ( আবু দাউদ: ২১৫৯)
পাশ্চাত্যের অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ব্লু ফিল্মের অভাব যেন মুসলিম সমাজে প্রবেশ না করে সেদিকে নবদম্পতির সতর্ক অবস্থানে থাকা উচিত।
বিয়ের প্রথম রাতে স্বামী স্ত্রীর করণীয় – সহবাসের মধ্যে অজু ও গোসল করা
বাসর রাতের আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি আমল হল- একবার স্ত্রী সহবাসের পর পুনরায় স্ত্রী সহবাসের পূর্বে অজু করা। হাদিসে আরও এসেছে , আম্মার ইবনে ইয়াসির থেকে বর্ণিত ।
নবীজি (সা.) অপবিত্র অবস্থায় পানাহার ও ঘুমানোর পূর্বে অযু করা বা না করার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। আলী ইবনে আবু তালেব ,আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ও আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, অপবিত্র অবস্থায় কেউ কিছু আহার করতে চাইলে অজু করে নিবে । ( আবু দাউদ: ২২৫ )
আর সহবাসজনিত অপবিত্রতার গোসল দ্রুত করা উত্তম । এটা অধিক পবিত্রতার বড় মাধ্যম । আত্মিক প্রশান্তি লাভের বড় উপকরণ । তবে বিলম্বে গোসল করা জায়েজ ।
আরও পড়ুন- Ayatul Kursi Bangla ( আয়াতুল কুরসি বাংলা ) উচ্চারণ ,অর্থ , অনুবাদ ও ফজিলত
গুদাইফ ইবনে হারিস (রহ.) থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে । তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)কে জিজ্ঞেস করি যে, রাসুল ( সা.) অপবিত্র হওয়ার পর রাতের প্রথমাংশে গোসল করতেন না শেষাংশে ?
তিনি বলেন, তিনি কখনো রাতের প্রথমাংশে এবং কখনো শেষাংশে গোসল করতেন । তখন আমি খুশিতে বলি, আল্লাহ মহান ,সমস্ত প্রশংসা তারই, যিনি এ কাজের জন্য প্রচুর সুযোগ রেখেছেন । ( আবু দাউদ: ২২৬)
বাসর রাতের করণীয় কী? – একান্ত বিষয়গুলো গোপন রাখা
ইসলামে মানুষের দোষ ত্রুটি প্রকাশ করে বিব্রত অবস্থায় ফেলা নিষেধ । স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয়ে অন্যের কাছে প্রকাশ করা ঠিক নয় । অন্যায় কাজ। যারা গোপনীয় বিষয়গুলো প্রকাশ করে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আবু দাউদের ২১৭১ নং দীর্ঘ বর্ণনায় নবীজি (সা.) তাদেরকে প্রকাশ্য শয়তাদের কর্মকান্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.)থেকে বর্ণিত হাদিসে ভয়ংকর পরিণতির বর্ণনা এসেছে । রাসুল (সা.)ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম মানুষ হবে ওই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয় । অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয় । (মুসলিম: ৩৪৩৪)
আরও পড়ুন- অবাধ্য সন্তান বাধ্য করার আমল | সন্তানকে বাধ্য করার উপায়
দাম্পত্য জীবনে কোন সমস্যা দেখা দিলে বিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া এবং শরিয়াতের বিধি বিধান জানার জন্য বিজ্ঞ আলেমদের দ্বারস্থ হওয়া নবদম্পতিদের জন্য একান্ত জরুরী । বাসর রাতের আমলের মধ্যে এটি অন্যতম।
লেখক: শরিফ আহমাদ (আলেম ও কবি)