বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে কম্পিউটার আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত কাজ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা কিংবা প্রশাসনিক কার্যক্রম—সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটারের ব্যবহার অপরিহার্য। তবে এই সুবিধাজনক যন্ত্রটির নিরাপত্তা সবসময় নিশ্চিত থাকে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকির নাম হলো কম্পিউটার ভাইরাস। এটি এমন একটি ক্ষতিকর সফটওয়্যার যা কম্পিউটারের ডেটা নষ্ট করে, পারফরম্যান্স কমিয়ে দেয় বা গোপন তথ্য চুরি করে নিতে পারে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের ভাইরাসের আক্রমণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অনেক ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে।
এই প্রবন্ধে আমরা জানবো কম্পিউটার ভাইরাস আসলে কী, এটি কীভাবে কাজ করে এবং বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর ও আলোচিত কয়েকটি কম্পিউটার ভাইরাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
কম্পিউটার ভাইরাস কি
কম্পিউটার ভাইরাস একটি ধরনের ক্ষতিকর সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম, যা কম্পিউটারে নিজের অনুলিপি তৈরি করে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরণের ক্ষতি করতে পারে। এটি সাধারণত অন্য কোনো ফাইল, সফটওয়্যার বা ইমেলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কম্পিউটারে প্রবেশ করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। ভাইরাসের প্রভাবে কম্পিউটারের গতি ধীর হয়ে যায়, প্রয়োজনীয় ফাইল নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিংবা সিস্টেম হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কখনও কখনও ভাইরাস গোপনে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতেও সক্ষম হয়।
কম্পিউটার ভাইরাসের উৎপত্তি ১৯৮০-এর দশকে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ধরন ও ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি বেড়েছে। আজকের দিনে নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট ও ইউএসবি ডিভাইসের মাধ্যমে ভাইরাস সহজেই একটি কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য ভালো অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা, সন্দেহজনক লিংক বা ফাইল না খোলা এবং নিয়মিত সিস্টেম আপডেট করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তাই, কম্পিউটারকে সুরক্ষিত রাখতে ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কম্পিউটার ভাইরাস কি কি ক্ষতি করে
কম্পিউটার ভাইরাস কম্পিউটার বা ডিভাইসের জন্য বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। নিচে কম্পিউটার ভাইরাসের প্রধান কিছু ক্ষতির দিক তুলে ধরা হলো।
- ডেটা নষ্ট বা চুরি হয়ে যাওয়া: ভাইরাস অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মুছে ফেলে, বিকৃত করে বা লুকিয়ে ফেলে। কিছু ভাইরাস আবার গোপনে সংবেদনশীল তথ্য (যেমন: পাসওয়ার্ড, ব্যাঙ্ক তথ্য) চুরি করে হ্যাকারদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
- কম্পিউটারের গতি কমিয়ে দেয়: ভাইরাস কম্পিউটারের র্যাম বা প্রসেসর ব্যবহার করে, ফলে সিস্টেম ধীর হয়ে যায়। সাধারণ কাজ করতেও অনেক সময় লাগে।
- সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম নষ্ট করে ফেলা: ভাইরাস অনেক সময় অপারেটিং সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নষ্ট করে দেয়, যার ফলে কম্পিউটার বুট নাও হতে পারে।
- অপ্রত্যাশিত আচরণ বা বার্তা প্রদর্শন: কিছু ভাইরাস পপ-আপ বার্তা দেখায়, অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ইনস্টল করে অথবা মাউস ও কিবোর্ডের কাজ ব্যাহত করে।
- নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া: ভাইরাস এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে নেটওয়ার্ক বা ইমেলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে পুরো অফিস বা প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম আক্রান্ত হতে পারে।
- ডিভাইস সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দিতে পারে: অত্যন্ত মারাত্মক ভাইরাস পুরো হার্ডড্রাইভ ফরম্যাট করে দিতে পারে, ফলে সবকিছু হারিয়ে যায় এবং কম্পিউটার আর কাজের উপযোগী থাকে না।
১০ টি কম্পিউটার ভাইরাসের নাম
-
ILOVEYOU Virus
-
ক্ষতি: ইমেলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একবার চালু হলে এটি ব্যবহারকারীর ফাইলগুলো (ছবি, ডকুমেন্ট, মিডিয়া) মুছে দেয় ও নিজের অনুলিপি পাঠিয়ে আরও কম্পিউটার আক্রান্ত করে।
-
-
WannaCry Ransomware
-
ক্ষতি: কম্পিউটারের ফাইল এনক্রিপ্ট করে ফেলত, অর্থাৎ ফাইল লক করে টাকা না দেওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করতে দিত না। ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারে আক্রমণ করেছিল।
-
-
Mydoom
-
ক্ষতি: এটি ইমেলের মাধ্যমে ছড়ায় এবং কম্পিউটারের গতি মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। এটি নিজে নিজেই অন্যদের মেইল পাঠায় ও নেটওয়ার্ককে ধীর করে দেয়।
-
-
Melissa Virus
-
ক্ষতি: মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ডকুমেন্টের মাধ্যমে ছড়ায় এবং Outlook থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইমেইল পাঠিয়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয়। এটি ডকুমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত করে।
-
-
Stuxnet
-
ক্ষতি: এটি বিশেষভাবে তৈরি একটি ম্যালওয়্যার যা ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে আক্রমণ করে। এটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং গোপনে নষ্ট করে।
-
-
Trojan Horse
-
ক্ষতি: এটি উপকারী সফটওয়্যারের ছদ্মবেশে কম্পিউটারে প্রবেশ করে। একবার চালু হলে এটি হ্যাকারকে রিমোট অ্যাক্সেস দেয় এবং ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করতে পারে।
-
-
Conficker
-
ক্ষতি: উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটি কম্পিউটারকে ধীর করে এবং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ নেয়।
-
-
CryptoLocker
-
ক্ষতি: এটি র্যানসমওয়্যার ভাইরাস, যা কম্পিউটারের ফাইল লক করে এবং মুক্তিপণের টাকা না দিলে ফাইলগুলো ডিলিট করে দেয়।
-
-
Code Red
-
ক্ষতি: এটি ওয়েব সার্ভারকে লক্ষ্য করে তৈরি, যা ওয়েবসাইট বিকৃত করে এবং অন্য কম্পিউটারে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ওয়েবসার্ভারের ওপর বিশাল চাপ তৈরি করে।
-
-
Zeus Virus
-
ক্ষতি: এটি ব্যাংক তথ্য ও পাসওয়ার্ড চুরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কীবোর্ডে কী টাইপ করা হচ্ছে তা রেকর্ড করে এবং হ্যাকারদের পাঠায়।
কম্পিউটার ভাইরাস আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচিত। এটি কেবল ফাইল নষ্ট বা চুরি করেই ক্ষান্ত হয় না, অনেক সময় পুরো কম্পিউটার সিস্টেম অকার্যকর করে দিতে পারে। WannaCry, ILOVEYOU, Trojan Horse, এবং Zeus-এর মতো ভাইরাসগুলো বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীর ক্ষতির কারণ হয়েছে।
তাই, কম্পিউটার ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। নিয়মিত অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার, সফটওয়্যার আপডেট এবং সতর্কতার সঙ্গে ইমেইল বা অনলাইনের তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ডিভাইসকে নিরাপদ রাখতে পারি। প্রযুক্তি যেন আমাদের সহায়ক হয়, ক্ষতিকর না—সে বিষয়ে আমাদের সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।