ডায়াবেটিস একটি নীরব ঘাতক রোগ যা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষকে আক্রান্ত করছে। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেখানে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা তৈরি হওয়া ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করে না। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখ ও স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেকেই জানতে চান—ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে কত হলে মানুষ মারা যায়? এই আর্টিকেলে আমরা সেই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।
সূচিপত্র
রক্তে শর্করার মাত্রা কত হলে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে?
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য রক্তে শর্করার একটি স্বাভাবিক সীমা আছে।
-
সাধারণ মানুষের জন্য (খালি পেটে): ৭০–৯৯ mg/dL
-
খাওয়ার পর ২ ঘণ্টা: ১৪০ mg/dL এর নিচে
-
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য (খালি পেটে): ৮০–১৩০ mg/dL
-
খাওয়ার পর ২ ঘণ্টা: ১৮০ mg/dL এর নিচে
কিন্তু যখন রক্তে শর্করা ৩০০–৪০০ mg/dL এর বেশি হয়, তখন তা খুবই বিপজ্জনক। আর যদি ৫০০ mg/dL বা তার বেশি হয়, তবে রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে। এ অবস্থাকে মেডিকেল ভাষায় বলা হয় হাইপারগ্লাইসেমিক ক্রাইসিস। এই পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারেন এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে।
ডায়াবেটিস বেড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কখন হয়?
ডায়াবেটিস হঠাৎ বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি বা হঠাৎ ইনসুলিন বন্ধ হয়ে যাওয়া। এতে দুটি মারাত্মক অবস্থা তৈরি হয়:
-
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (DKA)
-
সাধারণত টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
-
যখন শরীরে ইনসুলিন একেবারে কমে যায়, তখন শরীর শক্তি উৎপাদনের জন্য চর্বি ভাঙতে শুরু করে। এতে কিটোন নামক ক্ষতিকর এসিড জমে যায়।
-
লক্ষণ: বমি, প্রচণ্ড তৃষ্ণা, শ্বাসকষ্ট, বিভ্রান্তি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
-
রক্তে শর্করার মাত্রা: ২৫০ mg/dL এর বেশি হলে ঝুঁকি বাড়ে।
-
-
হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপারসমোলার সিনড্রোম (HHS)
-
সাধারণত বয়স্ক টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের হয়।
-
শরীরে প্রচণ্ড পানিশূন্যতা এবং রক্তে অত্যধিক শর্করা জমে যায়।
-
লক্ষণ: অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি, মস্তিষ্কে সমস্যা।
-
রক্তে শর্করার মাত্রা: ৬০০ mg/dL এর বেশি হলে জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।
-
অতএব বলা যায়, ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা যদি ৪০০–৬০০ mg/dL এর বেশি হয়, তবে মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যন্ত বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে কী কী জটিলতা হয়?
যদি রক্তে শর্করা দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, তবে তা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
-
হৃদরোগ ও স্ট্রোক: উচ্চ রক্তে শর্করা রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
-
কিডনির সমস্যা (নেফ্রোপ্যাথি): কিডনির ছাঁকনি ধ্বংস হয়ে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমে যায়।
-
চোখের সমস্যা (রেটিনোপ্যাথি): দৃষ্টিশক্তি কমে যায় এমনকি অন্ধত্বও হতে পারে।
-
স্নায়ুর ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি): হাত-পা ঝিনঝিন করা, ব্যথা বা অসাড় হয়ে যাওয়া।
-
ডায়াবেটিক ফুট: ক্ষত শুকাতে দেরি হয়, সংক্রমণ বেড়ে যায় এবং অনেক সময় অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, অতিরিক্ত শর্করার কারণে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।
ডায়াবেটিস বেড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে করণীয়
-
নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করুন এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলুন।
-
ইনসুলিন বা ওষুধ কখনো নিজে থেকে বন্ধ করবেন না।
-
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন—চিনি, মিষ্টি ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন।
-
নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করুন।
-
প্রচুর পানি পান করুন, কারণ পানিশূন্যতা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিপজ্জনক।
-
হঠাৎ দুর্বলতা, অতিরিক্ত তৃষ্ণা, বমি বা অজ্ঞান হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে হাসপাতালে যান।
ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে কত হলে মানুষ মারা যায়—তার সুনির্দিষ্ট উত্তর হলো, সাধারণত রক্তে শর্করা ৪০০–৬০০ mg/dL এর বেশি হলে জীবন হুমকির মুখে পড়ে এবং দ্রুত চিকিৎসা না করলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। তবে আসল বিষয় হলো, শুধু একটি উচ্চ মাত্রাই নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে হৃদরোগ, কিডনি বিকল বা স্ট্রোকের মতো জটিলতার মাধ্যমে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই ডায়াবেটিসকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ওষুধ এবং চিকিৎসকের পরামর্শই পারে আপনাকে এই নীরব ঘাতক রোগ থেকে রক্ষা করতে।