বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হলো গার্মেন্টস শিল্প। এই খাতে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক দেশের রপ্তানি আয়ের বড় একটি অংশ নিশ্চিত করে আসছেন। তবে গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মীদের বেতন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্ক ও আলোচনা চলমান। অনেকেই জানতে চান—এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা আসলে কত বেতন পান? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে কর্মীর পদমর্যাদা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং কারখানার ধরন ও অবস্থানের ওপর। এই লেখায় তুলে ধরা হলো বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ বেতন, বিভিন্ন পদ অনুযায়ী বেতনের ধারণা এবং বর্তমান বাস্তবতা।
ন্যূনতম বেতন কত: সরকারি ঘোষণা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশ সরকার ২০২৩ সালের নভেম্বরে গার্মেন্টস খাতের জন্য নতুন ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে, যা কার্যকর হয় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে। নতুন ঘোষণায় বলা হয়, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন হবে ১২,৫০০ টাকা। এর মধ্যে মৌলিক বেতন (বেসিক), বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা অন্তর্ভুক্ত।
তবে বাস্তবে অনেক ছোট-মাঝারি গার্মেন্টস কারখানায় এখনও অনেকে আগের হার অনুযায়ী, অর্থাৎ ৮,০০০–১০,০০০ টাকা মাসিক বেতন পাচ্ছেন। মূলত যারা সহকারী বা এন্ট্রি-লেভেল মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন, তাদের বেতন কম হয়ে থাকে।
এছাড়া অনেক সময় শ্রমিকরা ওভারটাইম ও ইনসেনটিভ পেয়ে মোট বেতন বাড়িয়ে নিতে পারেন। যেমন, ওভারটাইম থাকলে ন্যূনতম বেতনে আরও ২,০০০–৫,০০০ টাকা পর্যন্ত যোগ হতে পারে।
পদভেদে গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন কাঠামো
গার্মেন্টস শিল্পে বিভিন্ন পদ ও দায়িত্বভেদে বেতনের ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়। নিচে কিছু সাধারণ পদ অনুযায়ী গড় বেতনের ধারণা দেওয়া হলো—
-
সুইং অপারেটর (মেশিনম্যান): ১২,৫০০ – ১৬,০০০ টাকা
-
হেল্পার/সহকারী: ১০,০০০ – ১২,৫০০ টাকা
-
কাটিং অপারেটর: ১৪,০০০ – ১৮,০০০ টাকা
-
লাইন চিফ / সেকশন ইনচার্জ: ১৮,০০০ – ২৫,০০০ টাকা
-
সুপারভাইজার / প্রোডাকশন অফিসার: ২৫,০০০ – ৪০,০০০ টাকা
-
গার্মেন্টস ইঞ্জিনিয়ার / টেকনিক্যাল এক্সপার্ট: ৪০,০০০ – ৭০,০০০ টাকা
-
ম্যানেজার / লাইন ম্যানেজার: ৬০,০০০ – ১,০০,০০০ টাকা+
উল্লেখ্য, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, কোম্পানির র্যাংক এবং লোকেশন অনুযায়ী বেতনে আরও তারতম্য হতে পারে।
সর্বোচ্চ বেতন কত পেতে পারেন একজন গার্মেন্টস কর্মী?
যদিও গার্মেন্টস খাত সাধারণভাবে স্বল্প মজুরির খাত হিসেবে পরিচিত, তবে অভিজ্ঞ ও উচ্চ পদে কর্মরতদের বেতন তুলনামূলকভাবে বেশি। যেমন—
-
একজন সিনিয়র গার্মেন্টস এক্সিকিউটিভ বা প্রোডাকশন ডিরেক্টর মাসিক ১.৫ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতন পেতে পারেন।
-
এক্সপোর্ট ম্যানেজার, মার্চেন্ডাইজিং অফিসার, বা কমপ্লায়েন্স হেড পদে বেতন হতে পারে ৮০,০০০ – ২,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
বড় গার্মেন্টস গ্রুপ যেমন Beximco, Ha-Meem, Square, DBL, Palmal ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থদের বেতন অনেকটাই প্রতিযোগিতামূলক।
গার্মেন্টস খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও এই সেক্টরে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সরকার নতুন মজুরি বোর্ড ঘোষণা করলেও বাস্তব বাস্তবতায় তার বাস্তবায়ন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। তবে সুখবর হলো, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে কর্মরতদের আয়ও ধীরে ধীরে বাড়ছে। একদিকে শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের টেকসই ব্যবসা বজায় রাখা—এই ভারসাম্য তৈরি করাই এখন সময়ের দাবি।