কোমরের ব্যথা বা লোয়ার ব্যাক পেইন একটি খুব সাধারণ সমস্যা, যা হাড়–গোড়ের দুর্বলতা, আঘাত, মাংসপেশির টান, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, অতিরিক্ত কাজ বা বয়সজনিত কারণে হতে পারে। অনেক সময় কোমরের ব্যথা সহ্য করা কষ্টকর হয়ে ওঠে এবং দ্রুত উপশমের জন্য অনেকে ট্যাবলেট ব্যবহার করেন। তবে কোন ট্যাবলেট কখন খাবেন, কীভাবে খাবেন এবং কারা সতর্ক থাকবেন—এ বিষয়ে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, কোমরের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে বা হাঁটতে কষ্ট হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
এই আর্টিকেলে কোমরের ব্যথা কমানোর সাধারণ কিছু ট্যাবলেটের নাম, তাদের ভূমিকা এবং নিরাপদে খাওয়ার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সূচিপত্র
কোমরের ব্যথা কেন হয়?
কোমরের ব্যথার কারণ অনেক—
-
মাংসপেশির স্ট্রেইন বা টান
-
ডিস্ক স্লিপ
-
স্নায়ুতে চাপ
-
দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকা
-
অতিরিক্ত ওজন
-
বয়সজনিত হাড়ের ক্ষয়
-
আর্থ্রাইটিস বা প্রদাহ
ব্যথার কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা ভিন্ন হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি।
কোমরের ব্যথা কমানোর সাধারণ ট্যাবলেটের নাম
১. প্যারাসিটামল (Paracetamol)
মৃদু থেকে মাঝারি ব্যথায় সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রচলিত ট্যাবলেট।
-
প্রদাহ কমায় না, কিন্তু ব্যথা কিছুটা কমায়
-
সাধারণ ব্যথা, জ্বর বা মাংসপেশির অস্বস্তিতে ব্যবহার করা হয়
২. ইবুপ্রোফেন (Ibuprofen)
NSAID গ্রুপের ওষুধ, ব্যথা ও প্রদাহ উভয়ই কমায়।
-
মাংসপেশির টান
-
কোমরের প্রদাহজনিত ব্যথা
-
আর্থ্রাইটিসে ব্যবহৃত
৩. ন্যাপ্রোক্সেন (Naproxen)
ইবুপ্রোফেনের মতোই, কিন্তু দীর্ঘক্ষণ কাজ করে।
-
দীর্ঘস্থায়ী কোমর ব্যথায় উপকারী
-
প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে
৪. ডাইক্লোফেনাক (Diclofenac)
জোরালো NSAID, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তার ব্যথা বেশি হলে দিয়ে থাকেন।
-
তীব্র কোমর ব্যথা
-
স্নায়ু ব্যথা
-
প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
৫. এসিক্লোফেনাক (Aceclofenac)
ডাইক্লোফেনাকের তুলনায় তুলনামূলক মৃদু কিন্তু ব্যথা কমাতে কার্যকর।
৬. থায়োকোলচিকোসাইড (Thiocolchicoside) বা অন্যান্য Muscle Relaxant
মাংসপেশির টান বা স্পাজম হলে ব্যবহৃত হয়।
-
প্রায়ই NSAID-এর সাথে দেওয়া হয়
-
মাংসপেশি শিথিল করে
৭. গ্যাবাপেন্টিন (Gabapentin) / প্রেগাবালিন (Pregabalin)
স্নায়ুর ব্যথা, বিশেষত সায়াটিকা বা নার্ভ কমপ্রেশন হলে ডাক্তার ব্যবহার করেন।
-
নিজে থেকে খাওয়া যাবে না
-
কেবল চিকিৎসকের পরামর্শে গ্রহণযোগ্য
৮. ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম ও বি-কমপ্লেক্স সাপ্লিমেন্ট
হাড় দুর্বলতা, নার্ভ ব্যথা এবং মাংসপেশির ঝাঁকুনি কমাতে সাহায্য করে।
-
দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় উপকারী
কোমরের ব্যথার ট্যাবলেট কীভাবে খাবেন? (নিরাপদ নিয়ম)
মনে রাখবেন—ব্যথার ওষুধ কখনো নিজের ইচ্ছেমতো লম্বা সময় খাওয়া যাবে না। নিচে সাধারণ নিরাপদ নির্দেশনা দেওয়া হলো:
১. খাবারের পর ট্যাবলেট নিন
NSAID ওষুধ খালি পেটে খেলে পেটে জ্বালা, আলসার বা গ্যাস্ট্রিক হতে পারে।
তাই সবসময় খাবারের পর সেবন করা ভালো।
২. প্রয়োজন অনুযায়ী স্বল্প মেয়াদে খান
ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক—এসব ৩–৫ দিনের বেশি নিজে সিদ্ধান্তে খাওয়া ঠিক নয়।
৩. একই ধরনের দুই ওষুধ একসাথে খাবেন না
যেমন—ইবুপ্রোফেন + ডাইক্লোফেনাক বা ন্যাপ্রোক্সেন + ইবুপ্রোফেন একসাথে নিলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৪. পানি বেশি পান করুন
ওষুধ শরীর থেকে বের হতে এবং কিডনির উপর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
৫. গ্যাস্ট্রিক প্রবণতা থাকলে পেটের ওষুধ লাগতে পারে
যেমন—Omeprazole বা Pantoprazole ডাক্তার দিয়ে থাকেন।
নিজে খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬. স্নায়ু ব্যথার ওষুধ নিজে শুরু করবেন না
Gabapentin বা Pregabalin ভুলভাবে খেলে মাথা ঘোরা, ঘুম ঘুম ভাব বা অন্যান্য সমস্যা হতে পারে।
৭. ব্যথা তীব্র হলে দ্রুত ডাক্তার দেখান
বিশেষ করে যদি—
-
পা অবশ লাগে
-
পা–পায়ের আঙুলে ঝিনঝিন হয়
-
হাঁটতে কষ্ট হয়
-
বাথরুম নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়
এসবই সায়াটিকা বা ডিস্ক স্লিপের লক্ষণ।
ওষুধ ছাড়াও কোমর ব্যথা কমানোর কার্যকর উপায়
১. গরম সেঁক
পেশির টান কমায় এবং ব্যথা প্রশমিত করে।
-
১৫–২০ মিনিট দিনে ২–৩ বার
২. হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং
-
ক্যাট–কাউ
-
কোবরা পোজ
-
কোমর ঘুরানো
এসব ব্যায়াম ডিস্ক ও মাংসপেশি শক্তিশালী করে।
৩. সঠিক ভঙ্গিতে বসুন
-
কোমর সোজা রাখুন
-
বেশি নরম বিছানায় না বসা ভালো
-
মোবাইল ব্যবহার করার সময় মাথা নিচু রাখবেন না
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
অতিরিক্ত ওজন কোমর ও মেরুদণ্ডের ওপর চাপ বাড়ায়।
কারা কোমর ব্যথার ট্যাবলেট নিজের ইচ্ছায় খাওয়া উচিত নয়?
-
গর্ভবতী নারী
-
কিডনি রোগী
-
ব্লাড থিনার ব্যবহারকারীরা
-
হার্টের রোগী
-
৬০ বছরের বেশি বয়সী
-
যাদের আলসার বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা আছে
এসব ক্ষেত্রে ওষুধ ডাক্তার ছাড়া খেলে বিপদ বাড়তে পারে।
কোমরের ব্যথা উপশমে ট্যাবলেট কার্যকর ভূমিকা রাখে, তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। ব্যথার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়াই মূল কাজ। ব্যথানাশক ওষুধ অতিরিক্ত সেবনে কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলীতে ক্ষতি হতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গি, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ—এই অভ্যাসগুলোই কোমর ব্যথা থেকে রক্ষা করে।