মুখের ভেতরের নরম মিউকাসে যে ছোট‑বড় সাদা বা হলদে রঙের ক্ষত দেখা যায়, আমরা তাকে সাধারণভাবে “মুখের ঘা” (mouth ulcer/canker sore) বলি। এগুলো ক্ষুদ্র হলেও কথা বলা, খাওয়া‑দাওয়া এবং এমনকি দাঁত ব্রাশ করার সময়ও জ্বালা‑যন্ত্রণা তৈরি করে। বেশির ভাগ ঘা সাত‑দশ দিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়; তবে ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে ঘরোয়া পদ্ধতির পাশাপাশি ওভার‑দ্য‑কাউন্টার (OTC) ওষুধ দ্রুত স্বস্তি দিতে পারে।
সূচিপত্র
মুখের ঘা: কী ও কেন হয়?
মুখের ঘার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় আঘাত (দাঁতের ধার লেগে কেটে যাওয়া, দাঁতের ব্রেস), অতিরিক্ত মানসিক চাপ, হরমোনের ওঠানামা, ভিটামিন B₁₂/ফোলেট/আয়রনের ঘাটতি, কিছু ওষুধের পার্শ্ব‑প্রতিক্রিয়া, এমনকি পারিবারিক জেনেটিক প্রবণতাও। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে সাধারণত এফথাস আলসার হয় না, কিন্তু ফাঙ্গাল সংক্রমণে আলাদা ঘা (যেমন ওরাল থ্রাশ) দেখা দিতে পারে।
ঘরোয়া চিকিৎসা: হাতের‑কাছে সহজ সমাধান
ভেষজ উপাদান ও রান্নাঘরের সামগ্রী দিয়ে প্রাথমিক ব্যথা‑জ্বালা সামলানো যায়। উষ্ণ লবণজল অথবা বেকিং‑সোডা মিশ্রিত পানিতে দিনে দুই‑তিনবার কুলকুচি করলে ঘা পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত থাকে, যা দ্রুত আরোগ্য টেনে আনে। মধুতে প্রাকৃতিক অ্যান্টি‑সেপটিক ও প্রদাহনাশক গুণ আছে—পরিষ্কার আঙুলে সরাসরি মধু লাগিয়ে দিনে কয়েকবার ব্যবহার করলে ব্যথা কমে। হলুদ গুঁড়ো ও মধুর পেস্ট, অ্যালোভেরা জেল, নারিকেল তেল, ক্যামোমাইল‑ভেজানো তুলা প্রভৃতিও কার্যকর। নিয়মিত ভিটামিন B কমপ্লেক্স গ্রহণ বা খাদ্যতালিকায় শাক‑সবজি যোগ করাও ঘা পুনরায় হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
ফার্মেসিতে পাওয়া ওষুধ: দ্রুত আরাম পাওয়ার কয়েকটি বিকল্প
১. কেনাকার্ট ০.১ % বুকাল পেস্ট (ট্রাইঅ্যামসিনোলোন অ্যাসিটোনাইড)—এই স্টেরয়েডমূলক জেল ঘায়ের উপর পাতলা আস্তর তৈরি করে প্রদাহ কমায় ও ব্যথা‑চুলকানি দূর করে। দিনে ২‑৩‑বার তুলতুলে হাতের ভেতরের দিকে লাগানো যায়।
২. ডেন্টোজেল বা ডেন্টোজেল‑জাতীয় জেল (কোলিন স্যালিসিলেট + লিডোকেইন)—স্থানীয় অবেদন ও অ্যান্টি‑ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাবের কারণে তাত্ক্ষণিক ব্যথানাশক হিসেবে জনপ্রিয়।
৩. বনজেলা/বংজেল—চোলিন স্যালিসিলেট ও সিট্যালকোনিয়াম ক্লোরাইডের কম্বিনেশন জেল, যা দ্রুত শীতল অনুভূতি এনে ঘা‑ঘর্ষণ থেকে সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশের ফার্মেসিতে আমদানি‑কৃত (Bonjela) ও দেশি (Bongel) দু’টি সংস্করণই পাওয়া যায়।
৪. হেক্সিজেল (ক্লোরহেক্সিডিন গ্লুকোনেট ১ %)—ব্যাকটেরিয়াঘটিত প্রদাহ ও সেকেন্ডারি সংক্রমণ ঠেকাতে কার্যকর অ্যান্টি‑সেপটিক জেল। দিনে ২‑বার পাতলা করে লাগিয়ে তারপর ৩০ মিনিট কিছু না খাওয়াই উত্তম।
৫. ক্যান্ডিড মাউথ পেইন্ট/জেল (ক্লোট্রিমাজোল)—যদি ফাঙ্গাস‑ঘটিত ঘা (ওরাল থ্রাশ) হয়, তবে এই অ্যান্টিফাংগাল দ্রবণ দিনে চার‑পাঁচবার তুলায় ভিজিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে বলেন অনেক চিকিৎসক।
ওষুধ লাগানোর আগে মুখ নরম ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিন এবং একই জেল বা পেস্ট টানা সাত দিনের বেশি ব্যবহার না‑করাই ভাল; লক্ষণ না কমলে ডেন্টাল‑সার্জন বা ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন ও প্রতিরোধমূলক পরামর্শ
যদি ঘা দুই সপ্তাহেরও বেশি স্থায়ী হয়, আকারে বড়/বেড়ে যায়, রক্তক্ষরণ বা উচ্চ জ্বর হয়, কয়েক মাসে চার‑পাঁচবারের বেশি পুনরাবৃত্তি ঘটে—তাহলে তা জটিল রোগের ইঙ্গিত হতে পারে। নিয়মিত ওরাল হাইজিন, নরম টুথব্রাশ, পানির পর্যাপ্ত গ্রহণ, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত বা অ্যাসিডিক খাবার এড়িয়ে চলা, এবং মানসিক চাপ কমানো—এসব অভ্যাস মুখে ঘা হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে দেয়।
মুখের ঘা সাধারণত ক্ষণস্থায়ী, তবে ব্যথার সময়টুকু ভয়ানক কষ্টকর। পরিচ্ছন্নতা, সুষম পুষ্টি ও স্ট্রেস‑মুক্ত জীবনযাপনই দীর্ঘমেয়াদে সেরা প্রতিরোধ। তবুও যখন ঘা দেখা দেবে, ঘরোয়া লবণজল‑কুলকুচি কিংবা মধু‑হলুদের পেস্টের সঙ্গে ফার্মেসির সঠিক জেল/পেইন্ট ব্যবহার করলে দ্রুত আরাম পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসক‑পরামর্শ বিহীন দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড বা ব্যথানাশক জেল ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন—নিজের মুখের সুস্থতা নিজের হাতেই।