PLID বা DISK Prolapse কিভাবে বুঝবেন? করণীয় কি

বর্তমান যুগে অনেক মানুষ দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা, ভারী ওজন তোলা বা ভুল ভঙ্গিতে চলাফেরা করার কারণে কোমর ব্যথায় ভুগছেন। এই কোমর ব্যথার অন্যতম কারণ হলো PLID (Prolapsed Lumbar Intervertebral Disc) বা সাধারণভাবে যাকে Disk Prolapse বলা হয়। এটি মূলত মেরুদণ্ডের হাড়ের মাঝের নরম ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করার ফলাফল। সমস্যাটি অবহেলা করলে তা দীর্ঘমেয়াদী পিঠের ব্যথা, পায়ের অবশ ভাব এমনকি চলাফেরায় অসুবিধার কারণ হতে পারে। তাই সময়মতো লক্ষণ বুঝে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া খুবই জরুরি।

PLID বা Disk Prolapse কী

PLID হলো এমন একটি অবস্থা যখন মেরুদণ্ডের দুইটি হাড়ের মাঝের ডিস্ক ফেটে বা সরে গিয়ে পার্শ্ববর্তী স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সাধারণত এই ডিস্কের ভেতরে থাকা নরম জেলির মতো অংশটি (nucleus pulposus) বাইরের শক্ত স্তরটি (annulus fibrosus) ফেটে বাইরে চলে আসে এবং স্নায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। এর ফলে কোমর, নিতম্ব বা পায়ে ব্যথা হয়। এই সমস্যা মূলত কোমরের নিচের অংশে (lumbar region) দেখা যায়, তবে ঘাড়েও হতে পারে।

PLID বা Disk Prolapse হওয়ার কারণ

ডিস্ক প্রোল্যাপস হওয়ার বেশ কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে। যেমন –

  • দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা

  • ভারী ওজন তোলার সময় ভুল ভঙ্গি

  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা

  • বয়সজনিত কারণে ডিস্কের স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়া

  • দুর্ঘটনা বা হঠাৎ ঝুঁকে কিছু তোলা

  • শারীরিক ব্যায়ামের অভাব

  • ধূমপান, যা রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে ডিস্কের ক্ষতি করে

See also  ডায়াবেটিক রোগী অসুস্থ হলে দ্রুত ব্যবস্থা কী নেবেন?

এই অভ্যাসগুলো দীর্ঘদিন চলতে থাকলে ডিস্ক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে PLID-এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

PLID বা Disk Prolapse এর লক্ষণ কিভাবে বুঝবেন

PLID সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে হঠাৎ করেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিচের লক্ষণগুলো দেখা গেলে PLID-এর সন্দেহ জাগতে পারে –

  • কোমরের নিচে স্থায়ী ব্যথা

  • এক বা দুই পায়ে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া

  • পায়ে অবশ ভাব বা ঝিনঝিন অনুভূতি

  • হাঁটতে বা বসতে কষ্ট হওয়া

  • পিঠে চাপ পড়লে ব্যথা বেড়ে যাওয়া

  • হাঁচি বা কাশি দিলে ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া

  • পায়ে দুর্বলতা বা ভারসাম্য হারানো

এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত একজন নিউরোলজিস্ট বা অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

PLID নির্ণয়ের উপায়

PLID নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক সাধারণত রোগীর শারীরিক পরীক্ষা ও উপসর্গ বিশ্লেষণ করেন। এরপর নিচের কিছু পরীক্ষা করা হয় –

  • MRI (Magnetic Resonance Imaging): এটি PLID নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভুল উপায়। এর মাধ্যমে ডিস্কের অবস্থান, ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ও স্নায়ুর ওপর চাপ দেখা যায়।

  • CT Scan: ডিস্ক ও হাড়ের গঠন পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়।

  • X-ray: এটি মেরুদণ্ডের সামগ্রিক অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে।

  • Neurological Test: পায়ের রিফ্লেক্স, অনুভূতি ও শক্তি পরীক্ষা করা হয় স্নায়ুর ক্ষতি বোঝার জন্য।

PLID বা Disk Prolapse এর চিকিৎসা ও করণীয়

প্রাথমিক অবস্থায় PLID অনেক সময় ওষুধ ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে সেরে যায়। তবে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে ব্যথার মাত্রা ও অবস্থার জটিলতার ওপর।

১. বিশ্রাম ও জীবনযাপনের পরিবর্তন

অতিরিক্ত বসে থাকা বা ভারী কাজ করা বন্ধ করতে হবে। সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও দাঁড়ানোর অভ্যাস তৈরি করতে হবে। বিছানায় সোজা হয়ে ঘুমানো এবং নরম গদির পরিবর্তে শক্ত গদি ব্যবহার করা উচিত।

২. ওষুধ সেবন

চিকিৎসক সাধারণত ব্যথানাশক ও প্রদাহনাশক ওষুধ দেন। অনেক সময় মাংসপেশি শিথিলকারী (muscle relaxant) ওষুধও দেওয়া হয়। তবে নিজে থেকে কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

See also  গর্ভাবস্থায় কোয়েল পাখির ডিম খাওয়ার উপকারিতা

৩. ফিজিওথেরাপি

ফিজিওথেরাপি PLID রোগীদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিগুলোর একটি। এতে বিশেষ কিছু ব্যায়াম ও ট্র্যাকশন থেরাপির মাধ্যমে পেশির চাপ কমানো ও স্নায়ুর ব্যথা উপশম করা হয়।

৪. ইনজেকশন থেরাপি

কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা খুব বেশি হলে চিকিৎসক কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন দিতে পারেন, যা প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

৫. সার্জারি

যদি ওষুধ বা ফিজিওথেরাপি তেমন কাজ না করে এবং স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে সার্জারি করা হয়। এই অস্ত্রোপচারে ক্ষতিগ্রস্ত ডিস্ক অপসারণ করা হয়, যা সাধারণত Microdiscectomy নামে পরিচিত।

PLID হলে যেসব ব্যায়াম করা উপকারী

PLID রোগীদের জন্য হালকা ব্যায়াম খুব উপকারী, যেমন –

  • হাঁটাচলা বা হালকা যোগব্যায়াম

  • “McKenzie Extension” ব্যায়াম

  • “Pelvic tilt” বা কোমর বাঁকানোর ব্যায়াম

  • নিতম্ব ও পিঠের পেশি শক্ত রাখার ব্যায়াম

তবে কোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।

PLID থেকে বাঁচার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

  • ভারী জিনিস তোলার সময় হাঁটু ভাঁজ করে তোলা উচিত

  • সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও দাঁড়ানো অভ্যাস করা

  • নিয়মিত শরীরচর্চা করা

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

  • পর্যাপ্ত পানি পান ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করা

  • দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে মাঝে মাঝে উঠে হাঁটা

PLID বা Disk Prolapse একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক যত্ন, বিশ্রাম ও চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণ সেরে উঠতে পারে। কিন্তু অবহেলা করলে তা স্থায়ী স্নায়ু ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই কোমর ব্যথাকে হালকাভাবে না নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই PLID প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়।

Leave a Comment