কৃমি দূর করার উপায়। কি খেলে কৃমি চলে যায়?

কৃমি আমাদের শরীরের এক অদৃশ্য শত্রু, যা গোপনে শরীরে বাসা বেঁধে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মাঝে কৃমি সংক্রমণ একটি সাধারণ কিন্তু অবহেলিত সমস্যা। অনেক সময় এই সমস্যা সহজেই ধরা পড়ে না, ফলে শরীরে বিভিন্ন পুষ্টিহীনতা, দুর্বলতা ও হজমের গোলযোগ দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, কাঁচা বা অপরিষ্কার খাবার খাওয়া এবং সঠিক সময়ে কৃমিনাশক ওষুধ না খাওয়া কৃমির প্রধান কারণ। এই আর্টিকেলে আমরা জানব বড়দের ঘন ঘন কৃমি হওয়ার কারণ, কৃমি দূর করার ঘরোয়া উপায়, গুড়া কৃমি দূর করার সহজ উপায় এবং গর্ভাবস্থায় কৃমি সমস্যার সঠিক সমাধান।

বড়দের ঘন ঘন কৃমি হওয়ার কারণ

অনেকেই মনে করেন কৃমি কেবল শিশুদের সমস্যা, তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝেও এটি একটি সাধারণ ও পুনরাবৃত্ত সমস্যা। ঘন ঘন কৃমি হওয়ার পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে:

  1. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব: ঘন ঘন হাত না ধোয়া, নখে ময়লা থাকা কিংবা অপরিষ্কার বিছানা ব্যবহার করা কৃমির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

  2. অনিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়া: প্রতি ৬ মাস বা ১ বছরে অন্তত একবার কৃমির ওষুধ খাওয়ার নিয়ম না মানলে শরীরে কৃমি থেকে যায়।

  3. কাঁচা/অপরিষ্কার খাবার খাওয়া: বিশেষ করে কাঁচা শাকসবজি, ফল কিংবা অপরিচ্ছন্ন মাছ-মাংস খাওয়ার ফলে কৃমি শরীরে প্রবেশ করে।

  4. জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়া: অপরিষ্কার বা দূষিত পানিতে থাকা পরজীবীও কৃমির জন্ম দেয়।

  5. বাথরুম ও শৌচাগার ব্যবহারে অসাবধানতা: অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহারে কৃমির ডিম শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

See also  পাতলা পায়খানা হলে কি খাবার খেতে হবে?

কৃমি দূর করার উপায়

কৃমি দূর করতে বাজারে নানা ধরনের ওষুধ পাওয়া গেলেও ঘরোয়া কিছু উপায় অত্যন্ত কার্যকর। নিচে কৃমি দূর করার কিছু কার্যকর সমাধান দেওয়া হলো:

১. কৃমিনাশক ওষুধ গ্রহণ

  • ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী বছরে ১-২ বার Albendazole বা Mebendazole জাতীয় ওষুধ খাওয়া উচিত।

  • প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৪০০ মি.গ্রা একবারই যথেষ্ট।

২. কাঁচা রসুন খাওয়া

  • প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১-২ কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে কৃমি দূর হয়।

  • রসুনে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান কৃমির বৃদ্ধি রোধ করে।

৩. পেঁপে বীজ

  • শুকনো পেঁপে বীজ গুঁড়ো করে সকালে এক চামচ মধুর সঙ্গে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

  • এটি পেটের পরজীবীদের ধ্বংসে সাহায্য করে।

৪. কাঁচা হলুদ ও গরম পানি

  • খালি পেটে এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে কৃমি দুর্বল হয় এবং শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

৫. নারকেল

  • সকালে কাঁচা নারকেল খাওয়া এবং ২ ঘণ্টা পর গরম দুধে ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে খেলে দ্রুত কৃমি বের হয়ে আসে।

গুড়া কৃমি দূর করার উপায়

গুড়া কৃমি, যা পিনওয়ার্ম নামে পরিচিত, সাধারণত রাতে মলদ্বারে চুলকানি সৃষ্টি করে। এটি সবচেয়ে বেশি হয় শিশুদের মাঝে হলেও বড়রাও আক্রান্ত হন। গুড়া কৃমি দূর করতে:

১. গুড়া কৃমির জন্য ওষুধ

  • ডক্টরের পরামর্শে Mebendazole বা Pyrantel Pamoate জাতীয় ওষুধ খাওয়া জরুরি।

  • একটি ডোজ খাওয়ার ২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া উচিত, যাতে পুনরায় সংক্রমণ না ঘটে।

২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা

  • প্রতিদিন পোশাক, বিছানার চাদর, তোয়ালে গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।

  • নখ ছোট করে কাটা এবং সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া জরুরি।

৩. মলদ্বার পরিষ্কার রাখা

  • রাতে ঘুমানোর আগে গরম পানিতে তুলা ভিজিয়ে মলদ্বার পরিষ্কার করলে কৃমির ডিমের বিস্তার রোধ হয়।

See also  পেট ব্যাথা কমানোর উপায়

৪. খাওয়ার পর হাত ধোয়া

  • খাওয়ার আগে ও পরে, টয়লেট ব্যবহারের পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেওয়া কৃমির সংক্রমণ রোধে সহায়ক।

গর্ভাবস্থায় গুড়া কৃমি দূর করার উপায়

গর্ভাবস্থায় কৃমি সমস্যা হলে অনেকেই চিন্তায় পড়ে যান, কারণ এই সময় অনেক ওষুধ খাওয়া নিরাপদ নয়। তবে কিছু নিরাপদ উপায়ে গর্ভাবস্থায় গুড়া কৃমি দূর করা সম্ভব:

১. চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া

  • প্রেগন্যান্সির সময় কৃমিনাশক ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

  • কিছু ওষুধ যেমন Pyrantel Pamoate দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে নিরাপদ, তবে প্রথম তিন মাসে এড়িয়ে চলা উচিত।

২. প্রাকৃতিক সমাধান

  • সকালে খালি পেটে এক কোয়া কাঁচা রসুন খাওয়া নিরাপদ এবং কার্যকর হতে পারে।

  • প্রচুর পানি পান এবং আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ হজমে সাহায্য করে ও কৃমি দূর করে।

৩. গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার রাখা

  • প্রতিদিন গোসল করা এবং অন্তর্বাস পরিবর্তন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • টয়লেট ব্যবহারের পর ভালভাবে ধোয়া ও শুকানো জরুরি।

৪. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

  • কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা, সবজি-ফল ভালো করে ধুয়ে খাওয়া এবং বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে দূরে থাকা কৃমি প্রতিরোধে সাহায্য করে।

কৃমি আমাদের শরীরের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পরজীবী হলেও কিছু সচেতনতা এবং নিয়মিত যত্নের মাধ্যমে এটি সহজেই প্রতিরোধ ও দূর করা সম্ভব। কৃমি দূর করতে কেবল ওষুধ নয়, বরং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্য সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যাদের বারবার কৃমির সমস্যা হয়, তাদের উচিত বছরে অন্তত একবার ডাক্তার দেখানো এবং পরিবারের সকল সদস্যের কৃমিনাশক খাওয়া নিশ্চিত করা। সুস্থ শরীর ও ভালো পেটের জন্য কৃমিমুক্ত জীবন গড়ুন।

Leave a Comment