ফাংগাল ইনফেকশন বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণ এমন এক ধরনের রোগ যা শরীরের ত্বক, ফুসফুস, চোখ কিংবা রক্তে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। বিশেষ করে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন ক্যান্সার রোগী, অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তি বা দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণকারীদের মধ্যে এই সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। এই ধরনের গুরুতর সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় একটি শক্তিশালী অ্যান্টিফাংগাল ওষুধ Voriconazole (ভোরিজোল)।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব — ভোরিজোলের কাজ, খাওয়ার নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
সূচিপত্র
Voriconazole (ভোরিজোল) কী?
Voriconazole হলো একটি triazole antifungal drug, যা ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করে সংক্রমণ নিরাময় করে। এটি মূলত Aspergillosis, Candidemia, Fusariosis, Scedosporium infection ইত্যাদি মারাত্মক ফাংগাল সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
এই ওষুধটি ট্যাবলেট, ইনজেকশন ও সাসপেনশন — তিন রূপে বাজারে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এটি সাধারণত Vorijol, Vorican, Vorizol, V-Fend নামেও পরিচিত।
ভোরিজোলের কাজ ও কার্যপ্রণালী
ভোরিজোল শরীরের ছত্রাক কোষের ergosterol উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই পদার্থটি ছত্রাক কোষের ঝিল্লি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন এটি বন্ধ হয়ে যায়, তখন ছত্রাক কোষের গঠন দুর্বল হয়ে পড়ে ও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
এভাবে ভোরিজোল সংক্রমণ বন্ধ করে শরীরকে সুস্থ করে তোলে। এটি বিশেষভাবে কার্যকর invasive fungal infections-এর ক্ষেত্রে, যেখানে সংক্রমণ রক্ত বা অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
ভোরিজোল ব্যবহারের ক্ষেত্র (Uses of Voriconazole)
১. Aspergillosis: ফুসফুসের ভেতরে ছত্রাক সংক্রমণ হলে এই ওষুধটি প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. Candidemia: রক্তে Candida ছত্রাক সংক্রমণ হলে কার্যকর।
৩. Fusarium Infection: চোখ বা ত্বকে Fusarium ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে ব্যবহৃত।
৪. Scedosporium Infection: অন্যান্য অ্যান্টিফাংগাল ওষুধ কাজ না করলে এটি বিশেষভাবে কার্যকর।
৫. Immunocompromised রোগী: ক্যান্সার, এইডস বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তিদের ফাংগাল সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।
ভোরিজোল খাওয়ার নিয়ম (Dosage & Administration)
ভোরিজোল খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নিচে সাধারণ ডোজের ধারণা দেওয়া হলো —
-
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য:
প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিগ্রা করে প্রতি ১২ ঘণ্টা অন্তর খেতে হয়। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডোজ পরিবর্তন করা হতে পারে। -
শিশুদের জন্য:
বয়স ও ওজন অনুযায়ী ডোজ নির্ধারণ করা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত ওষুধটি তরল (suspension) আকারে দেওয়া হয়। -
ইনজেকশন ফর্ম:
গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয়।
⚠️ খাওয়ার নিয়ম:
-
ওষুধটি খালি পেটে খাওয়া উত্তম (খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে বা ১ ঘণ্টা পরে)।
-
ওষুধ খাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
-
নির্ধারিত সময়ে ডোজ না খেলে যত দ্রুত সম্ভব খেতে হবে, তবে একসাথে দুই ডোজ নেওয়া যাবে না।
ভোরিজোলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side Effects)
যেকোনো অ্যান্টিফাংগাল ওষুধের মতো ভোরিজোলেরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। নিচে সাধারণ ও গুরুতর উভয় প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো —
সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
-
মাথাব্যথা
-
বমি ভাব বা বমি
-
পেট ব্যথা
-
ত্বকে র্যাশ বা অ্যালার্জি
-
দৃষ্টিক্ষীণতা (চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোতে সমস্যা)
-
ঘুমের সমস্যা বা মাথা ঘোরা
গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যদি দেখা দেয় তবে দ্রুত চিকিৎসককে জানান):
-
ত্বক বা চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া (লিভার ক্ষতি)
-
হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হওয়া
-
মানসিক বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন
-
শ্বাসকষ্ট বা বুক ব্যথা
-
হাত-পা ফুলে যাওয়া
ভোরিজোল ব্যবহারে সতর্কতা (Precautions & Warnings)
ভোরিজোল অত্যন্ত কার্যকর হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি বিপজ্জনক হতে পারে। তাই নিচের সতর্কতাগুলো অবশ্যই মেনে চলা জরুরি —
ক. লিভার বা কিডনি সমস্যা থাকলে:
এই ওষুধ লিভার এনজাইম বৃদ্ধি করতে পারে। তাই যাদের পূর্বে লিভার বা কিডনির সমস্যা আছে, তাদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।
খ. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী:
ভোরিজোল গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি করতে পারে। তাই গর্ভবতী বা স্তন্যদানরত নারীদের জন্য এটি নিরাপদ নয়।
গ. গাড়ি চালানো বা মেশিন পরিচালনা:
ওষুধটি খাওয়ার পরে মাথা ঘোরা বা দৃষ্টি সমস্যা দেখা দিতে পারে, তাই এসময় গাড়ি চালানো বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করাই ভালো।
ঘ. অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া:
Voriconazole অনেক ওষুধের সঙ্গে মিশে বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যেমন – Rifampicin, Carbamazepine, Phenytoin, Warfarin ইত্যাদি। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একসাথে নেওয়া উচিত নয়।
ঙ. অ্যালার্জি থাকলে ব্যবহার নিষিদ্ধ:
যদি পূর্বে Voriconazole বা অন্য কোনো azole antifungal ওষুধে অ্যালার্জি থাকে, তবে এই ওষুধ ব্যবহার করা বিপজ্জনক হতে পারে।
ভোরিজোল ব্যবহারে করণীয় ও বর্জনীয়
করণীয়:
-
চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া।
-
নির্ধারিত সময়ে ডোজ গ্রহণ করা।
-
চিকিৎসা চলাকালীন রক্ত, লিভার ও কিডনি টেস্ট করা।
-
ওষুধ খাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পানি পান করা।
বর্জনীয়:
-
প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ খাওয়া যাবে না।
-
হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।
-
অ্যালকোহল সেবন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
ভোরিজোল কতদিন খেতে হয়?
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাধারণত ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত খেতে হতে পারে। সংক্রমণের তীব্রতা ও রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী সময়কাল নির্ধারিত হয়। মনে রাখতে হবে, ওষুধ বন্ধ করলে সংক্রমণ আবার ফিরে আসতে পারে, তাই পুরো কোর্স সম্পূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি।
Voriconazole বা ভোরিজোল একটি শক্তিশালী অ্যান্টিফাংগাল ওষুধ, যা ছত্রাকজনিত গুরুতর সংক্রমণ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এটি ব্যবহার করতে হবে কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে, কারণ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ওষুধের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া জটিল হতে পারে। সঠিক ডোজ, নির্ধারিত সময় ও নিয়ম মেনে ওষুধ খেলে এটি জীবনের জন্য রক্ষাকারী প্রমাণিত হতে পারে।