গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়। এই সময়ে সঠিক পুষ্টি গ্রহণ করা না হলে মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য দু’জনেরই ক্ষতি হতে পারে। ডিম এমন একটি খাবার যা প্রোটিন, ভিটামিন এবং মিনারেলে ভরপুর। অনেকেই মুরগি বা হাঁসের ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেন, তবে ছোট আকৃতির কোয়েল পাখির ডিমও (Quail Egg) গর্ভাবস্থায় অসাধারণ উপকার দিতে পারে।
এই ডিমটি ছোট হলেও এতে রয়েছে প্রায় ১৩ ধরনের ভিটামিন ও খনিজ, যা গর্ভবতী মায়ের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। চলুন জেনে নেওয়া যাক গর্ভাবস্থায় কোয়েল পাখির ডিম খাওয়ার উপকারিতা, সঠিক নিয়ম ও কিছু সতর্কতা।
সূচিপত্র
কোয়েল পাখির ডিমের পুষ্টিগুণ
কোয়েল ডিম দেখতে ছোট হলেও এটি পুষ্টির এক বিশাল উৎস। এতে ভিটামিন এ, বি২, বি৬, বি১২, ডি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ওমেগা-৩ ও প্রোটিনের পরিমাণ প্রচুর।
একটি কোয়েল ডিমে প্রায় ১.২ গ্রাম প্রোটিন থাকে এবং এতে মুরগির ডিমের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি আয়রন ও ফসফরাস রয়েছে। এছাড়া এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষগুলোকে সুরক্ষা দেয় ও ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
গর্ভাবস্থায় কোয়েল ডিম খাওয়ার উপকারিতা
১. মা ও শিশুর জন্য প্রোটিন সরবরাহ করে
গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি ও মায়ের শরীরের টিস্যু গঠনে প্রোটিনের ভূমিকা অপরিসীম। কোয়েল ডিমে প্রচুর প্রোটিন থাকে যা শরীরের কোষ পুনর্গঠন করে এবং শিশুর হাড় ও পেশি গঠনে সহায়তা করে।
২. রক্তাল্পতা প্রতিরোধে কার্যকর
গর্ভাবস্থায় অনেক নারীর শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) হয়। কোয়েল ডিমে থাকা আয়রন ও ফসফরাস রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা মায়ের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও শিশুকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে।
৩. মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে
কোয়েল ডিমে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং কোলিন গর্ভের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শিশুর স্মৃতিশক্তি ও স্নায়ুতন্ত্রের উন্নতি ঘটায়। তাই গর্ভাবস্থায় কোয়েল ডিম খাওয়া শিশুর মানসিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
কোয়েল ডিমে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের ফ্রি র্যাডিকেল দূর করে, ফলে মা ও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এটি গর্ভাবস্থায় সর্দি, জ্বর বা অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
৫. হাড় ও দাঁত মজবুত করে
এই ডিমে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা মায়ের ও শিশুর হাড়, দাঁত ও নখ শক্ত করে। এছাড়া এটি শিশুর হাড়ের গঠন সঠিকভাবে বিকাশে সাহায্য করে।
৬. মানসিক প্রশান্তি ও ঘুমে সহায়তা করে
কোয়েল ডিমে থাকা ভিটামিন বি৫ ও বি৬ স্নায়ুর চাপ কমায় এবং মুড ভালো রাখতে সাহায্য করে। অনেক গর্ভবতী নারী ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, কোয়েল ডিমে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ও ট্রিপটোফ্যান ঘুম উন্নত করে ও মানসিক প্রশান্তি দেয়।
৭. ত্বক ও চুলের যত্নে সহায়ক
গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অনেকের ত্বক ও চুলে সমস্যা দেখা দেয়। কোয়েল ডিমে থাকা ভিটামিন ই ও বায়োটিন ত্বকের উজ্জ্বলতা বজায় রাখে এবং চুল পড়া রোধে সহায়তা করে।
গর্ভাবস্থায় কোয়েল ডিম খাওয়ার নিয়ম
-
দিনে ১ থেকে ২টি কোয়েল ডিম খাওয়া যথেষ্ট।
-
ডিম ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে, কাঁচা বা আধা সিদ্ধ খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
-
সকালে নাস্তার সাথে বা দুপুরে ভাতের সাথে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী।
-
অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ এতে উচ্চ কোলেস্টেরল হতে পারে।
কোয়েল ডিমের অপকারিতা ও সতর্কতা
১. উচ্চ কোলেস্টেরল সমস্যা
কোয়েল ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই যাদের কোলেস্টেরল বা হৃদরোগের সমস্যা আছে, তাদের এটি পরিমিতভাবে খাওয়া উচিত।
২. এলার্জি প্রতিক্রিয়া হতে পারে
কিছু গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে ডিমে থাকা প্রোটিনে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে, যেমন চুলকানি, হাঁচি বা ত্বকে লাল দাগ। এমন হলে ডিম খাওয়া বন্ধ করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৩. ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি
কাঁচা বা আধা সিদ্ধ ডিম খেলে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে, যা গর্ভবতী নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সবসময় ভালোভাবে সিদ্ধ করে খাওয়া আবশ্যক।
৪. ওজন বৃদ্ধি হতে পারে
কোয়েল ডিমে প্রচুর ক্যালোরি থাকে। অতিরিক্ত খাওয়া হলে ওজন দ্রুত বাড়তে পারে, যা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বা প্রেসার বাড়াতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কোয়েল ডিম বনাম মুরগির ডিম: কোনটি ভালো?
মুরগির ডিম সহজলভ্য ও হজমে সহজ, তবে কোয়েল ডিমে প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন বি১২ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ অনেক বেশি।
গর্ভবতী মায়েরা সপ্তাহে ২–৩ দিন কোয়েল ডিম এবং বাকি দিনগুলোতে মুরগির ডিম খেলে শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে।
স্বাস্থ্য টিপস: কোয়েল ডিম খাওয়ার সময় যা মনে রাখতে হবে
-
সবসময় তাজা ও পরিস্কার ডিম বেছে নিন।
-
একসাথে বেশি পরিমাণে না খাওয়াই ভালো।
-
ডায়াবেটিস বা প্রেসারের সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
-
ডিমের সাথে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও পানি গ্রহণ করুন।
গর্ভাবস্থায় কোয়েল পাখির ডিম একটি চমৎকার পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার। এতে থাকা প্রোটিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ওমেগা-৩ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে যেকোনো খাবারের মতোই পরিমিত মাত্রায় খাওয়াই সঠিক।
নিয়মিত ও সঠিকভাবে কোয়েল ডিম খেলে গর্ভবতী মা যেমন সুস্থ থাকবেন, তেমনি গর্ভের শিশুরও সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত হবে।